ডেস্ক রিপোর্ট : সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের পর জামিন আবেদন ঘিরে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে একজন আইনজীবীর মৃত্যু হয়েছে, আহত হয় অন্তত ২০ জন। এসব ঘটনায় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বরাতে এ তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
পোস্টে শফিকুল আলম লিখেছেন, চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি লেখেন, জনগণকে শান্ত থাকার এবং অপ্রীতিকর কার্যকলাপে অংশ নেওয়া থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বন্দর নগরীসহ সমস্ত ঝুঁকিপূর্ণ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
যেকোনো মূল্যে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে ও সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও জানিয়েছেন ড. ইউনূস।
এর আগে, মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে সৃষ্ট সংঘর্ষে নিহত হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। নিহত আলিফ (৩৫) সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি)। সাইফুল লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে।
জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালত চিন্ময়ের জামিন নামঞ্জুর করেন। পরে তার অনুসারীরা আদালত চত্বরে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় কয়েকজন আহত হন।
আহতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আহত শিক্ষানবিশ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে মৃত ঘোষণা করেন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কলকাতাতেও বিক্ষোভ হয়েছে। তার আটকের বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন)। তিনি ‘বাংলাদেশে ইসকনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা’ উল্লেখ করে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
যদিও ৮ নভেম্বর একটি সংবাদ সম্মেলনে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ইসকনের যাবতীয় কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়ার তথ্য জানিয়েছিল সংগঠনটি।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে সোমবার ঢাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার দুপুরে মহানগর আদালতে তার জামিনের শুনানির সময় নির্ধারিত ছিল।
সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গনে শত শত হিন্দু ধর্মাবলম্বী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। পাশাপাশি আদালত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল।
তার জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর আদালত চত্বরেই চিন্ময় দাসকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি ঘিরে ধরে বিক্ষুব্ধরা।
এক পর্যায়ে প্রিজন ভ্যান থেকেই চিন্ময় দাস পুলিশের সরবরাহ করা হ্যান্ডমাইকে অনুসারীদের শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার আহ্বান জানান।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে চিন্ময় দাসকে বলতে দেখা যায়, “রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট হয় আমরা এইরকম কিছু করবো না। আবেগকে সংযত করে, আবেগকে শক্তিতে পরিণত করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন।’’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা পৌনে তিনটা পর্যন্ত অনড় অবস্থানে থাকা আন্দোলনকারীদের মুহূর্মুহু স্লোগানে প্রিজন ভ্যানে থাকা চিন্ময় দাসকে নিয়ে আদালত প্রাঙ্গন ছেড়ে যেতে পারেনি পুলিশ।
অনেকে প্রিজন ভ্যানের সামনেই শুয়ে পড়েন। চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেয় বিক্ষোভকারীরা। এক পর্যায়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডও ছোঁড়ে পুলিশ।
সেই সময় অনেকটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয় আদালতসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা। ভাঙচুর করা হয় আশপাশের বিভিন্ন দোকানসহ স্থাপনায়। সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় আইনজীবীসহ বেশ কিছু মানুষ আহত হন। এছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ছাত্র–জনতার একটি অংশ। কয়েক ঘণ্টা ধরে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে।
চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার ও জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় মঙ্গলবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত সরকার।
নয়া দিল্লি থেকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “এ ঘটনা বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর চরমপন্থীদের দ্বারা ধারাবাহিক হামলারই অনুসরণ।’’
এদিকে, এ গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
তিনি বলেছেন, “কেউ যদি রাষ্ট্রদ্রোহের মতো ঘটনায় যুক্ত থাকে, সে যেই হোক, যত বড় নেতাই হোক, তাকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না।’’
সোমবার সন্ধ্যায়ই চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানা গেলে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ করে তার অনুসারীরা। ঢাকায় শাহবাগে এবং মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে চিন্ময় দাসের অনুসারীরা।
শাহবাগে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হলে তাদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। শাহবাগ মোড়ে একদল ব্যক্তি লাঠি নিয়ে তাদের ওপর হামলা করে বলে ফেসবুক লাইভে অভিযোগ করা হয়েছে, যদিও হামলাকারীদের পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এ ঘটনায় কোনো মামলা বা থানায় অভিযোগ হয়নি।
সোমবার রাতেই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রংপুরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ ছাড়া গতকাল রাতেই খুলনা, দিনাজপুর, রাঙামাটি এবং কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায়ও বিক্ষোভ হয়।