নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্পদ ও স্বপ্ন—সবকিছু হারিয়ে গেছে বানের তোড়ে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, জনপদ পরিণত হয়েছে এক ধু ধু প্রান্তরে। ফেনীর লাখ লাখ মানুষ বন্যার ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। খোলা আকাশের নিচে কেবল ক্ষুধা, কান্না, আর্তনাদ, আর বেঁচে থাকার জন্য অদম্য আকুতি। কেউ গাছে, কেউ টিনের চালে, কেউবা ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার অবস্থা সবচেয়ে করুণ। স্বজনরা নিখোঁজ, যোগাযোগ নেই, খবর নেই বেঁচে আছে কি না। ত্রাণ, উদ্ধার কাজেও দেখা দিয়েছে অসঙ্গতি। মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, ইন্টারনেটও নেই।
ফেনীর জগতপুর গ্রামের বাসিন্দা খালেদুর রহমান নৌকায় পাঁচজনকে উদ্ধার করে শহরে নিয়ে আসেন। তার চোখেমুখে উদ্বেগ আর আতঙ্কের ছাপ। মানুষের কষ্ট দেখে আসা খালেদুর জানান, বিশাল জনপদ যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যেখানে মানুষ ছিল, এখন সেখানে কেবল পানি। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না শুনে হৃদয় বিদীর্ণ হয়, কিন্তু তাদের বাঁচানোর মতো উপায় নেই।
বন্যা এত প্রলয়ঙ্করী হবে তা ফেনীর মানুষ কল্পনাও করেনি। সম্পদ হারিয়েছে, এখন জীবনের সংশয়। উজানে অতি ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যায় ফেনীর প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় এ পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেনীসহ দেশের ১১টি জেলা প্লাবিত হয়েছে, ৭৭ উপজেলায় ৪৮ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ চলছে, তবে পরিস্থিতির উন্নতি ধীরগতিতে হচ্ছে।
ফেনীর মানুষ এখন স্বজনের সন্ধানে। কেউ মোবাইল বন্ধ, কেউ ফেসবুক লাইভে বাঁচার আকুতি জানিয়েছে। কোথাও কোনো খবর নেই, বেঁচে আছেন কি না জানা যাচ্ছে না। সুমন আহমেদ নামে একজন জানান, ছাগলনাইয়ার নিজপানুয়া স্কুলের কাছে একটি গ্রাম আটকা পড়েছে। সেখানে খাবার নেই, শিশুরা কান্না করছে, কেউ সাহায্য করতে আসছে না।
উদ্ধার কাজে সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা নিজেরাই বিভ্রান্ত, কোথায় যেতে হবে, কীভাবে সমন্বয় করতে হবে তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও কষ্টের অন্ত নেই—বিদ্যুৎ নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই, খাবার নেই। চিকিৎসা নেই। তবুও জীবনের আশায় মানুষ টিকে আছে, অপেক্ষায় রয়েছে সাহায্যের।
ফেনী শহরের অধিকাংশ বাসা হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এখন ত্রাণ নয়, বরং জরুরি স্পিডবোট ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা চাচ্ছে। কারণ, না খেয়ে দু’দিন থাকা সম্ভব, কিন্তু পানির নিচে দুই মিনিটও থাকা সম্ভব নয়।
এই বন্যা শুধুমাত্র ফেনী নয়, দেশের আরও অনেক অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় বন্যার ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি, অনেকেই নিখোঁজ। পরিস্থিতির উন্নতি ধীরগতিতে হচ্ছে, তবে জীবনের তাগিদে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে।