জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী আজ

আজ ২৪ মে, ২০২৪, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, এবং সমাজসংস্কারক হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলার জনগণের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। নজরুলের ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল। তিনি মক্তবে আরবি ও ফার্সি ভাষা শেখার মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করতেন, যেখানে তিনি ইসলামী সঙ্গীত ও সুরে আগ্রহী হন।

সাহিত্যিক কর্মজীবন
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯১৯ সালে। তাঁর প্রথম কবিতা “মুক্তি” প্রকাশিত হয় “সওগাত” পত্রিকায়। এই কবিতার মাধ্যমে নজরুল জাতীয় ও সামাজিক বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। তাঁর সাহিত্যিক কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিদ্রোহী চেতনা ও মানবতা। ১৯২২ সালে প্রকাশিত “বিদ্রোহী” কবিতাটি তাঁকে জাতীয় কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। এই কবিতায় তিনি বিদ্রোহী আত্মাকে ফুটিয়ে তোলেন এবং সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান জানান।

সংগীতজীবন
নজরুলের সঙ্গীতজীবন বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তিনি প্রায় ৪,০০০ গান রচনা করেছেন, যা নজরুলগীতি নামে পরিচিত। তাঁর গানে দেশপ্রেম, মানবতা, ভালোবাসা, এবং স্নেহের আবেগময় মিশ্রণ পাওয়া যায়। নজরুলের গানের কথায় যেমন গভীরতা আছে, তেমনি সুরেও আছে অসাধারণতা। তাঁর গানের বৈচিত্র্য ও বৈচিত্র্যময়তা বাংলা সঙ্গীতকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবতা
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবতার প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁর রচনায় দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য ভালোবাসা ও সম্মানের কথা উল্লেখ আছে। তাঁর কবিতা ও গানে তিনি বারবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এবং মানবতার মহান আদর্শে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র সাহিত্যিক বা সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতা ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে এবং তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেন। তাঁর সাহসী লেখনী ও কর্মকাণ্ড তাঁকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্যতম প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

জীবনের শেষ অধ্যায়
নজরুলের জীবনের শেষ অধ্যায় ছিল অত্যন্ত কষ্টময়। ১৯৪২ সালে তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন এবং তাঁর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর থেকে তিনি জীবনের বাকি সময়টা নীরবে কাটান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

নজরুলের উত্তরাধিকার
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর রচনা ও সঙ্গীত আজও বাংলার জনগণের জীবনের অংশ হিসেবে থেকে গেছে। তাঁর বিদ্রোহী চেতনা, মানবতার প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা, এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে তিনি আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন।

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি সাহিত্যের মাধ্যমে জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করেছিলেন এবং মানবতার পক্ষে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিদ্রোহ ও মানবতা পাশাপাশি চলতে পারে এবং একটি সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সঙ্গীতে প্রভাব
নজরুলের সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রভাব বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। তাঁর রচনায় সমাজের বিভিন্ন সমস্যার কথা, মানবতার জয়গান এবং প্রেমের আবেগময় প্রকাশ ঘটেছে। নজরুলের রচনায় প্রধানত যে বিষয়গুলি উঠে এসেছে, তা হলো সাম্য, মানবতা, এবং সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

নজরুলের কবিতায় যেমন “বিদ্রোহী”, “কামাল পাশা”, “ধুমকেতু” ইত্যাদিতে বিদ্রোহী চেতনা পাওয়া যায়, তেমনি তাঁর গানে যেমন “কারার ঐ লৌহ কপাট”, “মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম”, “একি অপরূপ রূপে মা তোমায়” ইত্যাদিতে দেশপ্রেম এবং মানবতার গভীরতর প্রকাশ দেখা যায়।

নজরুলের জীবনী থেকে শিক্ষা
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি তা হলো সাহস, সততা, এবং ন্যায়পরায়ণতা। তিনি সমাজের সকল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সদা প্রস্তুত ছিলেন এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন। নজরুলের জীবনী আমাদের শিখায় যে, একজন মানুষের সাহসী কাজ ও কথার মাধ্যমে সমগ্র সমাজকে পরিবর্তন করা সম্ভব।

আজ নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এবং তাঁর রচনাগুলি পুনরায় পাঠ করে আমাদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করি। তাঁর সৃষ্টিকর্ম আমাদের জীবনে আলোর পথ দেখাবে এবং আমাদের ন্যায়পরায়ণতা ও মানবতার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করবে।

কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাঁর জীবন ও কর্মের মূলে আমরা খুঁজে পাই একটি সমাজকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে একজন সাহসী কবি ও মানবতাবাদীর অসামান্য প্রচেষ্টা। তাঁর সৃষ্টি আমাদের জীবনে চিরকালীন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *