মোঃ সোহেল রানা, রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান : হুন্ডি মুকুলের রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী বালু ঘাটে সাড়ে সাত হাজার টাকা মূল্যের বালু এখন ৯হাজার টাকা বিক্রি করছেন হুন্ডি মুকুলের ভাই মোঃ বাবু। এতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। অপর দিকে বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। এ নিয়ে ব্যাবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। একাধীক ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গত তিনদিন আগেও প্রেমতলী বালু ঘাটে মোটা বালুর দাম ছিল ড্রামট্রাক ভাড়া-সহ ৭,৫০০/- টাকা, বর্তমানে সেই বালুর দাম ৯ হাজার টাকা। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ বালু ব্যাবসায়ীরা। তারা বলছেন একাধীক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও পাড়া মহল্লার বিভিন্ন বিল্ডিং নির্মানের বালু সাপ্লাইয়ের কাজ চলছে পূর্বের মূল্যে। হটাৎ ট্রাকপ্রতি ১,৫০০/-টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে করে পূর্বের সাপ্লাই কাজগুল তারা বন্ধ রেখেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন কাষ্টমার ধরে রাখতে ট্রাকপ্রতি ১৫০০টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। এছাড়াও পাড়া মহল্লার লোকজন যারা নতুন ইমারত নির্মান করছেন তারা একপ্রকার বাধ্য হয়েই উচ্চমূলে বালু ক্রয় করছেন। সবমিলে বালু ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা হুন্ডি মুকুলের প্রেমতলী বালু ঘাটে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। প্রতিকার পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেনর তারা।
এ ব্যপারে মুঠো ফোনে জানতে চাইলে হুন্ডি মুকুলের ভাই মোঃ বাবু জানান, বর্ষা মৌসুম চলছে। বালু উত্তোলতে খরচ বেশি পড়ছে। তাই বালুর মূল্য বাড়ানো হয়েছে। তবে ৫ আগষ্টের একাধীক মামলার আসামী মখলেছুর রহমান মুকুল ওরফে হুন্ডি মুকুল আত্মগোপনে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায় নি। উল্লেখ্য, এক সময়ের মুদি দোকানদার রাজশাহীর মখলেছুর রহমান মুকুল ওরফে হুন্ডি মুকুল। গত ৫ আগস্ট থেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি তিনিও পলাতক রয়েছেন। তবে তার কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ পড়ে আছে রাজশাহীতে। হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে মুকুল এখন অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক। তিনি চড়েন দেড় কোটি টাকা দামের কালো রঙ্গের একটি পাজেরো গাড়ীতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই মুকুলের রাজশাহী এবং ঢাকায় অন্তত ৪টি বাড়ি রয়েছে। এছাড়াও নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় শত কোটি টাকা মূল্যের সাত তলা আবাসিক ভবন রয়েছে। রয়েছে দুটি দামি গাড়ি এবং অন্তত ৪০ বিঘা জমি। এর মধ্যে রাজশাহী শহরেই রয়েছে তার অন্তত ২০ বিঘা জমি। যার আনুমানিক মূল্য অন্তত ২০০ কোটি টাকা। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে সৌদি আরবেও রয়েছে হুন্ডি মুকুলের হোটেল ব্যবসা। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে সেখানে দুটি আবাসিক হোটেল কিনেছেন মুকুল। দুটির একটি হলো মদিনায় আরেকটি মক্কাতে। হুন্ডি ব্যবসায়ী মুকুলকে নিয়ে এর আগেও একাধিক অনুসন্ধানী খবর প্রকাশ হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট ওই খবর প্রকাশের পর বেশকিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। তবে মাস তিনেক পরে আবারও এলাকায় ফিরে আসেন তিনি। এর পর তাঁর টাকাগুলো হালাল করতে তিনি ঠিকাদারী ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনে সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুকুল রাজশাহী সিটি করপোরেশনেরই অন্তত ৪০০ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেন গত তিন বছরে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের তৎকালীন এমপি আসাদুজ্জামান আসাদকে একটি পাজেরো গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। কথিত রয়েছে, পবা এলাকার একটি বালুঘাট কম মূল্যে পাইয়ে দেওয়ার জন্য ওই গাড়ীটি উপহার দিয়েছিলেন এমপি আসাদকে। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের সঙ্গেও ছিল মুকুলের গভীর সখ্যতা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ পুলিশ হেডকোয়াটর্সের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখা রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা হুন্ডি ও মাদক চোরাকারবারিদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকায় থাকা চোরাকারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজশাহীর মখরেছুর রহমান মুকুল। তার সঙ্গে ভারতের অন্যতম চোরাকারবারি এনামুলের ব্যবসায়ীক পার্টনার ছিলেন মুকুল। এনামুলেরই অন্তত ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন মুকুল। অথচ তিনি একসময় ছিলেন মুদি ব্যবসায়ী। নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় ছিল তার মুদির দোকান। ভারতীয় সীমান্ত এলাকা রাজশাহী শহরের এই কাশিয়াডাঙ্গা দিয়ে এক সময় বিপুল চোরাচালান হত। মুদি ব্যবসার আড়ালে একসময় সেই চোরাচালানের সঙ্গে এবং পরবর্তিতে হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মুকুল। পরবর্তিতে গরু চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে মুকুলের পরিচয় ঘটে ভারতীয় চোরাকারবারি এনামুল হকের সঙ্গে।
ভরত সরকার একসময় নগদ টাকা ধর-পাকড় শুরু করলে এনামুল অন্তত এক হাজার রুপি পাঠিয়েছিলেন রাজশাহীর মুকুলের কাছে। পরবর্তিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে কিছু টাকা এনামুলকে ফেরত দেন আর আর অন্তত ৫০০ কোটি রুপি আত্মসাত করেন মুকুল। সেই থেকে মুকুল অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান। তার চলাচলেও আসেও রাজকীয় ভাব। পালানোর আগে দেড় কোটি টাকা মূল্যের গাড়ী ব্যবহার করতেন এই মুকুল।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালে করা দেশের হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তালিকায় দ্বিতীয় নামটি ছিলো রাজশাহীর মখলেছুর রহমান মুকুলের। আমদানি-রপ্তানির নামের মুন এন্টার প্রাইজ নামে এই মুকুলও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন ভারতসহ বিভিন্ন দেশে।
নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা আনিসুজ্জামান বলেন, মুকলের তো তেমন কিছুই ছিল না। এখন সেই লোক কিবাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হলো বলতে পারব না। শুনেছি হুন্ডির মাধ্যমে সে এতো টাকার মালিক হয়েছে। তাই এলাকার মানুষ তাকে হুন্ডি মুকুল নামেই চিনে বেশি। তবে এসব বিষয়ে যোগাযোগের জন্য চেষ্টা করা হলেও মুকুলকে পাওয়া যায়নি। তার ফোনও বন্ধ রয়েছে।