বিশেষ প্রতিনিধি: শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন উৎখাতের পর গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠিন পথ অতিক্রম করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হওয়া অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র সংস্কারের আশা পূরণ করতে হবে নতুন সরকারকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকারের সামনে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ বেকারত্বের মতো বড় চ্যালেঞ্জ। তারা বলেন, একদলীয় শাসনের অধীনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অপশাসন, দুর্নীতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন সরকারকে এই ক্ষোভ প্রশমিত করতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বিশাল পরিমাণ বিদেশি ঋণের চাপ মোকাবিলা করা। তাছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি মেটানোও জরুরি।
আইনশৃঙ্খলা
১৬ জুলাই আবু সাঈদের হত্যার পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে চার শতাধিক আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন, এবং বহুসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ঢাকা শহরের অধিকাংশ থানা পুলিশ ছেড়ে চলে যায়, ফলে বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি-ঘরে হামলা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মন্দিরে নাশকতা ঘটে।
অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শাহাব উদ্দিন খান বলেছেন, পুলিশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য সেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা চলছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং বাহিনীর আত্মবিশ্বাস ফেরানোর জন্য কাজ করা হচ্ছে।
রাষ্ট্র সংস্কার
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এক আইনজ্ঞ বলেছেন, নতুন সরকার সংবিধান বাতিলের চিন্তা করতে পারে। অভ্যুত্থানকারী শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তুলেছে, কিন্তু তা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তা স্পষ্ট নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংবিধানে বড় পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে এবং নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনা নিয়ে গণপরিষদ গঠনের পরিকল্পনা করছে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী এখনো সংস্কার বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি।
জনপ্রত্যাশার চাপ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন বলেছেন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী জনতার প্রত্যাশা পূরণ করা নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। অপশাসন, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
নতুন সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরও সরকারের কাজে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে, তবে কিভাবে তাদের সম্পৃক্ত করা হবে তা এখনও নির্ধারিত হয়নি।
অর্থনৈতিক চাপ
অর্থনীতির দুরবস্থা এবং কমতে থাকা রিজার্ভ নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রপ্তানি কমেছে এবং অর্থনীতি নিয়ে ভুয়া তথ্য দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, নতুন সরকারকে দ্রুত অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে হবে।
অভ্যুত্থানের কারণে উৎপাদন এবং রপ্তানিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা এখনও চলমান। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বিশ্বের শীর্ষ বাজারে যুক্ত থাকলেও সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে কিছু ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।
নির্বাচন ও সরকারের মেয়াদ
সংবিধান অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে রয়েছে। তবে, কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে, অন্যদিকে কিছু দল নির্বাচন পেছানোর পক্ষে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং আন্দোলনের দাবি বাস্তবায়ন। নতুন সরকারের মেয়াদ এবং নির্বাচন নিয়ে এখনও স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
আরও চ্যালেঞ্জ
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন এবং ভারতের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং কয়েকটি দেশের সহায়তার সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা নতুন সরকারের জন্য জরুরি। সামরিক নেতৃত্বের প্রভাব নিয়েও আলোচনা চলছে, যদিও এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী সরকারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আগ্রহী নয়।