ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট, রাজশাহী প্রতিনিধি : রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) বর্তমানে এক চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় একটি শক্তিশালী পুরনো সিন্ডিকেট ব্যাংকের অভ্যন্তরে অর্থ আত্মসাৎ, বদলি বাণিজ্য এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাকে জিম্মি করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর ‘মব চাপ’ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যার ফলে ব্যাংকজুড়ে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।
ব্যাংকের একাধিক অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, রাকাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—একাধিক উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও কর্মকর্তার—এই সিন্ডিকেটে সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যানও সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করছেন। সিন্ডিকেটটি তাদের স্বার্থরক্ষায় নিম্নলিখিত কৌশলগুলো ব্যবহার করছে।
বদলি বাণিজ্য: সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন করে আসছিল। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা সম্প্রতি এই অনিয়ম শনাক্ত করে বদলি প্রক্রিয়া স্থগিত করলে, ক্ষুব্ধ সিন্ডিকেট সদস্যরা ‘মব’ জড়ো করে ব্যাংক ব্যবস্থাপককে চাপ প্রয়োগ শুরু করে। স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলেও সিন্ডিকেটের পছন্দসই আদেশ না পেলে আবারও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
মব তৈরি করে চাপ সৃষ্টি: পদায়নের বিষয়ে অসন্তুষ্ট হলে সিন্ডিকেট সদস্যরা সরাসরি মব বা উচ্ছৃঙ্খল লোক জড়ো করে ব্যবস্থাপককে আলটিমেটাম দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সিন্ডিকেটের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছেন কয়েকজন উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে: ঋণ আদায় বিভাগ ২ এর উপ-মহাব্যাব্যস্থাপক মো. মিজানুর রহমানকে সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ জোনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, এই পদায়নের পর তিনি স্থানীয় কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক দিয়ে ব্যাংকের সামনে মব তৈরি করেন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আলটিমেটাম দেন।
এ বিষয়ে জানতে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি, ফলে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আইসিটি অপারেশন বিভাগের উপ-এমডি মো. আবুল কালামের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ, ডিজিটাইজেশনের নামে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
দুদক অনুসন্ধান: এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি অনুসন্ধানকারী দল গঠন করে তদন্ত শুরু করেছে। দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী দলের প্রধান মোঃ আমির হোসাইন স্বাক্ষরিত চিঠিতে (গত ৩০ অক্টোবর) রাকাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের (Tender ID: 744072-AMC of Network devices) তদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন রেকর্ডপত্র ও তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে পূর্বে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে তিনি আইসিটি সিস্টেম বিভাগে থাকতে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীর কাছে ‘দৌড়ঝাঁপ’ করছেন এবং আর্থিক সুবিধা দিচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি নিজেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন এবং সিন্ডিকেটের মব তৈরিতেও ভূমিকা রাখছেন।
এ বিষয়ে জানতে উপ-এমডি আবুল কালামের মুঠোফোনে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি, ফলে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিতর্কিত পদায়ন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসন্তোষ
উপ-মহাব্যবস্থাপক খায়রুল ইসলামকে সম্প্রতি লালমনিরহাট জোনে পুনরায় পদায়ন করা হয়। জানা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সতর্কতা দেওয়া হয়েছিল এবং এই পুনরায় পদায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অসন্তোষ প্রকাশ করে। এরপরেও চেয়ারম্যান ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তাঁকে বদলিতে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চেয়ারম্যানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন: সার্কুলার লঙ্ঘন
ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যানের ভূমিকা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার ২-এর ১০.১ (ঘ)(অ) ধারা অমান্য করে বদলি প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশনামূলক পত্র পাঠিয়েছেন। সার্কুলার অনুযায়ী, বদলি সংক্রান্ত বিষয়ে চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। ব্যাংকজুড়ে গুঞ্জন রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে চলা বদলি বাণিজ্যের আর্থিক সুবিধা চেয়ারম্যান পর্যন্ত পৌঁছায়।
ডিজিএম আবুল কালামের সহযোগী হিসেবে সিন্ডিকেটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন আইন বিভাগের উপ-এমডি জাকির হোসেন এবং এমটিএফপি অ্যান্ড বিসিডি বিভাগের মুখ্য কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম।
রাশেদুল ইসলামের উদ্ধত আচরণ: রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিয়মিত দপ্তরে উপস্থিত থাকেন না এবং প্রকাশ্যে দাবি করেন, “আমাকে বদলি করার ক্ষমতা কারো নেই।” তাঁর এই উদ্ধত মনোভাব সিন্ডিকেটের ভিতরের শক্তির ইঙ্গিত দেয়।
এসব গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে রাকাব কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য দেয়নি। তবে ব্যবস্থাপনা সূত্র জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কাজ করছে এবং ব্যাংকের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।
দুদকের তদন্ত এবং সিন্ডিকেটের অব্যাহত চাপ—এই দুইয়ের মুখে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ব্যাংকটিকে পুরনো সিন্ডিকেটের আধিপত্য থেকে মুক্ত করে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।