# ডোমরা লাশ বিক্রির সাথে জড়িত
# দেশে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে
# আজিমপুর ও জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়
বেওয়ারিশ লাশ
# প্রশাসনের কাছে নেই সঠিক পরিসংখ্যানও
# আট বিভাগে তদারকির বড়ই অভাব
মনির হোসেন জীবন, বিশেষ সংবাদদাতা : রাজধানীতে অভিভাবকহীন ও বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা আগের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে বেড়েই চলেছে। ডোমরা লাশ বিক্রির সাথে জড়িত এবং তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মূলত মৃত মানুষের মরদেহ ও কঙ্কাল সংগ্রহ করে পরবর্তীতে উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে লাশ ! ডোমরা চোরাকারবারি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যদের সাথে গোপনে আঁতাত কিংবা যোগসাজশের মাধ্যমে লাশ নিজের স্বজনের বলে কোনো কোনো সময় পরিচয় দিয়ে থাকে। বর্তমানে ঢাকা নগরীসহ দেশজুড়ে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বেড়েই বাড়ছে। এক্ষেত্রে দেশের আট বিভাগে রয়েছে তদারকির বড়ই অভাব।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, বেওয়ারিশ লাশ সব কি দফন হচ্ছে? যদি তা না হয় তবে কি বিক্রি হচ্ছে সেসব লাশ? কীভাবে বিক্রি হয় এবং কারা জড়িত? এসব বিষয় গুলো সরকার তথা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের খতিয়ে দেখা উচিৎ। বেওয়ারিশ লাশ বিক্রির সাথে ডোম ও তাদের সহযোগী এবং শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা জড়িত। পুলিশ সদরদপ্তর বলছে, বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা নির্ধারণ করার এক্ষেত্রে তাদের কাছে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশ্বস্থ তথ্য সূত্রের।
তথ্য অনুসন্ধান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সূত্র গুলো বলছে, যে সকল লাশ ৭ দিন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো স্বজনের সন্ধান পাওয়া যায় না সেই মরদেহ গুলো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গণ্যকরা হয়। অনেক ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ডোম কিংবা প্রতারক চক্রের সংঘবদ্ধ সদস্যরা বেওয়ারিশ লাশগুলো কৌশলে চুরি করানো হয়। তারপর তা মেডিসিন ব্যবহার করে পঁচিয়ে কঙ্কাল বানিয়ে পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে চড়া দামে অন্যত্র বিক্রি করে একটি প্রভাবশালী মহল। দীর্ঘ দিন ধরে চোরাকারবারি সংঘবদ্ধ চক্রের একাধিক সদস্য নগরজুড়ে বেওয়ারিশ লাশ ও মানবদেহের কঙ্কাল বিক্রির সাথে জড়িত রয়েছে। বিগত ১৪/১৫ মাস ধরে এ ধরনের ব্যবসা বীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তারা দেশের প্রতিটি জেলা ভিত্তিক বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিভাগীয় শহরে গড়ে তুলেছে আস্তানাও। সেকারণেই প্রতি বছরই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা। একই সাথে ডোমরা লাশ বিক্রির সাথে জড়িত থাকারও অভিযোগ আছে। বেওয়ারিশ লাশ গুলো দাফন করার দায়িত্ব আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের উপর গিয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ওইসব মরদেহ গুলো নগরীর আজিমপুর কিংবা জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়ে থেকে ।
সংশ্লিষ্ট ও হাসপাতাল সূত্র গুলো বলছে, দেশের মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার জন্য মূলত দু’ভাবে মানবদেহের কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়ে থেকে । মানুষের কঙ্কালের পরিবর্তে এখন কৃত্রিম কঙ্কালও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে বেওয়ারিশ লাশের সঠিক পরিসংখ্যান নেই এমমনটাই বলছে পুলিশ সদরদপ্তর। মৃত মানুষের কঙ্কাল সংগ্রহ ও লাশ বিক্রির সাথে একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) হাসপাতালের সাবেক অ্যানাটমি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সামিনা গণমাধ্যমকে বলেন, মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার জন্য দু’ভাবে কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্য অনেকে নিজের দেহ দান করেন। এর বাইরেও তাছাড়া মানুষের কঙ্কালের পরিবর্তে এখন কৃত্রিম কঙ্কালও ব্যবহার করা হয়। তবে কৃত্রিম কঙ্কাল দিয়ে শিক্ষার বিষয়টি সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এছাড়া দামও তুলনামূলক বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা নগরীসহ দেশের নামি-দামি হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, মেডিকেলে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় কঙ্কালের প্রয়োজন হয়ে থাকে । বেওয়ারিশ লাশ ও কঙ্কাল সংগ্রহ করা সেটাও আবার বৈধভাবে নয়। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা অর্থের বিনিময়ে লাশ ঘরের ডোমদের সাহায্যে কঙ্কাল সংগ্রহ করে মেডিকেলের চিকিৎসার চাহিদা মেটায়।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক উত্তরা, গাজীপুর, সাভার মিরপুর, আগারগাঁওসহ একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ প্রতিবেদককে বলেন, মেডিকেলের ছাত্রদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কঙ্কাল সরবরাহ করার একটি নীতিমালা সরকারি ভাবে করা উচিত। যেটা বাইরের দেশে একটি আইন আছে কিন্তু আমাদের দেশে সে আইন ও নীতিমালা নেই বললেই চলে। নির্ভরযোগ্য সূত্র ও সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলো বলছে, দেশে মেডিকেল কলেজ ও কবরস্থান কেন্দ্রিক চক্রগুলো এবং হাসপাতালের ডোমদের মধ্যে ভোলার বাসিন্দা ডোম লাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলের অসাধু কিছু চিকিৎসক, শিক্ষার্থী এবং মর্গের নিয়োগপ্রাপ্ত ও চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীরা। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে বেওয়ারিশ লাশ বিক্রির সঙ্গে একাধিক চক্রের সদস্যরা জড়িত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, তথ্য পরিসংখ্যান ও এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি বছরই বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বেওয়ারিশ মরদেহ ছিল ৪৪৩ টি। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯০ টিতে। আর এ বছর প্রথম ৩ মাসেই বেওয়ারিশ মরদেহ মিলেছে ১২৬ জনের বেশি। ২০২৪ সালে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ৫৭০ টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে।
গত ১৮ নভেম্বর, ২০২৫ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)র উপপুলিশ কমিশনার তালেবুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলন সাংবাদিকদের জানান, গত ১০ মাসে রাজধানীতে ১৯৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
তারমধ্যে রাজধানীতে গড়ে ২০টির মত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে বলেও দাবি করেন ডিএমপির এই মুখপাত্র। একাধিক সূত্র বলছে, দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, পূর্ব শত্রুতা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কারণে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বেশিরভাগ দেশেই পরিচয়হীন মরদেহ এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের আলাদা ডেটাবেজ ও ওয়েবসাইট রয়েছে। কেউ নিখোঁজ হলে প্রথমে সেখানে জানায় স্বজনরা। থানায় জিডিও করা হয়ে থাকে। অথচ দেশে বেওয়ারিশ লাশের (অশনাক্তকৃত মৃতদেহ) ক্ষেত্রে আইন রয়েছে, যা মৃতদেহ শনাক্তকরণ, ময়নাতদন্ত, এবং দাফন বা সৎকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে। যদি কোনো মৃতদেহ শনাক্ত করা না যায়, তবে পুলিশ তার পরিচয় জানার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়, যেমন আঙুলের ছাপ সংগ্রহ ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো। এরপর আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মতো সেবামূলক সংস্থা লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করে। এসব বিষয়ে আঞ্জুমান মফিদুলের লাশ দাফনকারী কর্মকর্তা মো. কামরুল সাংবাদিকদের জানান, আমরা লাশ ঠিকঠাক ভাবে দাফন করি। পরে কী হয় সেটা বলতে পারবো না।
ঢামেকের সাবেক অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, বেওয়ারিশ লাশ সরকারি হাসপাতাল থেকে নিয়ে সংরক্ষণের কোনো বিধান নেই। লাশ কাটা ঘরের কর্মচারীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ডোম থেকে শুরু করে হাসপাতালের কর্মচারীরা মোটা অঙ্কের টাকা রোজগারের লোভ সামলাতে না পেরে এসব কাজে দিনদিন যুক্ত হচ্ছেন বলে ধারণা করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরেনসিক বিভাগের অপর এক চিকিৎসক গণমাধ্যমকে জানান, ডোমদের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক না দেওয়া ও ময়নাতদন্তে আইনি প্রক্রিয়া না থাকায় অনেকটা তাঁদের অবহেলায় পড়তে হচ্ছে ।
এ বিষয়ে ডিএমপি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, বেওয়ারিশ লাশের আলামত ও ছবি তুলে রাখা হয়। পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির বর্ণনাও লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে । অনেক ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতায় বেওয়ারিশ লাশ বেওয়ারিশই থেকে যায়। পুলিশ সদরদপ্তর বলছে, বেওয়ারিশ লাশের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এব্যাপারে সরকার প্রধান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট মহলকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ।