নিজস্ব প্রতিবেদক: সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রেখে দশম গ্রেডের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শিক্ষকদের লাগাতার অবস্থান ও ৬৫ হাজার ৫৬৯টি বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ১ কোটি ছয় লাখের বেশি কোমলমতি শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। জানা গেছে, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৫৬৯টি। মোট শিক্ষক পৌনে চার লাখের বেশি। শিক্ষকদের মধ্যে সহকারী শিক্ষকের অনুমোদিত পদ আছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২১৬টি। তবে বর্তমানে কর্মরত সহকারী শিক্ষক ৩ লাখ ৫২ হাজার ২০৮ জন। ১৭ হাজার ৮টি পদ শূন্য।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, চলতি বছরের অক্টোবর মাসে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৫ প্রধান শিক্ষককে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের বিদ্যমান ১১তম গ্রেড থেকে সরকারি বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা জাতীয় বেতন-স্কেলের ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। তাদের ১১তম গ্রেড দিতে অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু, ১০ম গ্রেডে করার দাবিতে এখন আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষকরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১০তম গ্রেডে শুরুর বেতন ১৬ হাজার টাকা, ১১তম ১২ হাজার ৫০০ টাকা, ১৩তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকা। এরসঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা যুক্ত হয়।
মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের কাজের গুণগত ও পরিমাণগত দিক দিয়ে আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড বাড়িয়ে ১০তম করার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা সম্মতি দিয়েছেন। তাই যৌক্তিকতা বিবেচনা করে সহকারী শিক্ষকদের বেতনস্কেল ১১তম গ্রেডে উন্নীত করা প্রয়োজন।
জানা গেছে, দশম গ্রেডসহ তিন দফা দাবিতে গত ৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন সহকারী শিক্ষকরা। আগামী ১৫ নভেম্বর কর্মবিরতিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রথমদিনের কর্মসূচিতে শাহবাগে শিক্ষকদের ওপর পুলিশ হামলা করায় কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে আসেন। ফলে গতকাল রোববার থেকেই সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দেয় ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, শিক্ষকদের ওপর পুলিশি হামলায় প্রাথমিক শিক্ষকসমাজ ক্ষুব্ধ। আমাদের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা রক্তাক্ত, অনেকের হাত-পায়ে বুলেটের স্লিপ্লন্টার বিদ্ধ হয়েছে। তারা হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। কয়েকজনকে আটক করে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অবশ্যই দেশের সব বিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষকরা। যৌক্তিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রজব আলী বলেন, তার সন্তান মোহাম্মদপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। এবার বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। কিন্তু শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণায় সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন রজব আলী। অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বন্ধ থাকায় রজব আলীর মতো বহু অভিভাবক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের নেতা আবুল কাশেম বলেন, সহকারি শিক্ষকরা দীর্ঘদিন দশম গ্রেডের দাবি জানালেও তা সম্ভব নয় বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এরপর শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডের জন্য আন্দোলনে নামেন। সেই দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেজন্য শিক্ষকরা আবারও আন্দোলনে নেমেছেন।
শহিদ মিনারে লাগাতার অবস্থানে শিক্ষকরা, দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি : তিন দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হওয়ার পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। তিন দফা বাস্তবায়ন না করে উল্টো শাহবাগে শিক্ষকদের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ। গতকাল রোববার সংগঠনের পক্ষে শিক্ষক নেতা মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়। শিক্ষকদের অভিযোগ, পুলিশ হামলা চালিয়েছে বিনা উসকানিতে। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, শিক্ষকরা বাধা উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে এগোলে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
সহকারী শিক্ষকদের হঠাৎ করে কীভাবে দশম গ্রেডে উন্নীত করব- উপদেষ্টা : এদিকে গত শনিবার খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অংশিজনের ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছেন, ‘সহকারী শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থান ১৩তম গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের আমরা সবেমাত্র দশম গ্রেডে উন্নীত করেছি, তাহলে সহকারী শিক্ষকদের হঠাৎ করে ১৩তম গ্রেড থেকে কীভাবে দশম গ্রেডে উন্নীত করব?’
অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘আমরা তিন দফা দাবি দেখেছি। প্রথমটা দশম গ্রেড, পরেরটা ১০ ও ১৬ বছরে সিলেকশন গ্রেড, তিন নম্বরটা শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি। আমরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রস্তাব করেছিলাম শতভাগ। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলেছে, সরকারের নীতি হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে শতভাগ না দিয়ে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ দেওয়া, ২০ শতাংশ আমাদের রাখতে হবে নতুন নিয়োগের জন্য। ফলে ওনাদের পরামর্শ মোতাবেক সেটা করা হয়েছে। ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে যে টাইম স্কেল, সেটা বেতন কমিশন দেখবে, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। দশম গ্রেড প্রসঙ্গে যেটা আসছে, প্রাথমিক শিক্ষকদের একটা অংশ এই দাবিটা করে, বেশির ভাগ শিক্ষক মনে করেন, এই দাবিটা মোটেই যৌক্তিক না।’
দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রধান শিক্ষকরা ১২ ও ১১ গ্রেডে বেতন পেতেন। বর্তমান সরকার তাদের দশম গ্রেডে উন্নীত করেছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বেশি। বড় আর্থিক সংশ্লেষ আছে এখানে। সরকার মনে করেছে প্রধান শিক্ষকদের দাবিটা যুক্তিসংগত ছিল। এ জন্য প্রধান শিক্ষকের দাবিটা আমরা বাস্তবায়ন করেছি।’ অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেড থেকে এক লাফ দিয়ে দশম গ্রেডে যাবেন, যেখানে মাত্র প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেড পেয়েছেন, এটা যুক্তিসংগত কি না, আপনারাই বিবেচনা করে দেখেন। আমি যতটুকু জানি, সহকারী শিক্ষকদের এই দাবিটা যুক্তিসংগত না।’ তিনি বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকেরা যাতে ১১তম গ্রেড পেতে পারেন, সে জন্য আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে লিখেছি, বেতন কমিশনে লিখেছি। বেতন কমিশন ছাড়াও অন্যান্য নীতিনির্ধারক যারা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে আমি লবিং করছি যে ১১তম গ্রেড যেন বাস্তবায়ন করা হয়। আমি কতটুকু পারব নিশ্চিত না। তবে আমি লেগে আছি। ফলে দশম গ্রেডের দাবি তুলে এই মুহূর্তে আন্দোলনে যাওয়া আমার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হয় না।
শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে পড়াশোনার ক্ষতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘ওনারা যেহেতু স্বাধীন দেশের নাগরিক, ওনাদের কথা বলার সুযোগ আছে। ওনারা আন্দোলন করতে পারেন। কিন্তু আমরা যেটা দেখব, আমাদের পড়াশোনা যাতে বিঘ্নিত না হয়। এই ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা নেব, যদি আমাদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনার মানের উন্নয়নের বিষয়টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। এই পর্যায়ে এসে যদি অযৌক্তিক দাবি দিয়ে কেউ পড়াশোনাকে বিঘ্নিত করে, সে জন্য আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।
এসব বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গ্রেড উন্নীত দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামার আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন। ক্লাস বন্ধ রেখে আন্দোলন করায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আবার জনদুর্ভোগও বাড়ছে।
শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা ঠিক হয়নি এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিগত ১৫ থেকে ১৬ বছর শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়নি সরকার। অথচ বছরে বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।
করোনার সময়ে শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দেশে কিশোরগ্যাং, মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ ও মাদকাসক্তি বেড়ে গেছে। শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে কিশোরগ্যাং, ডিভাইস আসক্ত ও মাদকাসক্তি আরও বাড়বে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী।