নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর মিরপুর এক নম্বর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে আশা সেবাগ্রহীতারা একটি সিন্ডিকেট দলের কাছে জিম্মি । এবং সাব রেজিস্ট্রি অফিসে বদলি হয়ে আসা সব সাব-রেজিস্ট্রার ওই সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন। সাবেক নাইট গার্ড মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, তার ঘনিষ্ঠ ফজর আলী, সাগর ও সবুজের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে অন্য সদস্যরা হলো, মোহাম্মদ পিয়াস, নয়ন, খোকন ও কামরুল সহ আরো অনেকেই। তারা দুর্নীতি -অপকর্ম করে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমিসহ বিভিন্ন ধরনের সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন। যা দলিল রেজিস্ট্রেশন, শ্রেণি পরিবর্তন, সাজানো দাতা, এনআইডি জালিয়াতিসহ নানা দুর্নীতি ও অনিয়মে লিপ্ত তারা।
একাধিক সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগে ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছে সেবানিতে আশা সাধারণ মানুষদের একের পর এক হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে । সিন্ডিকেটের সদস্যরা দীর্ঘদিন একই অফিসে থাকার কারণেই জমি সংক্রান্ত সব কাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রেখেছে। ওই অফিসের সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও তাদের কাছে জিম্মি। তারা রাতকে দিন বানায় দিনকে রাত বানায় এভাবেই চলে তাদের কর্মকাণ্ড। সিন্ডিকেটের মূল হোতা ফজর আলী ও সাগর মূলত সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
এদিকে সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য সাবেক নাইটগার্ড মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন উক্ত অফিসে চাকরিরকালীন দুর্নীতি ও নিয়মের মাধ্যমে সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে জমি সংক্রান্ত বিষয়ে সব কাজ করে দিত। এভাবেই দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরে পর বছর অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে আহমদ নগর শাহ আলী বাগ এলাকায় বিলাস বহুল আলিশান একটি সাড়ে ৬ তলা বাড়ি করেছেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও এখনো মিরপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে এসে দালালির কাজ করছেন। সেই বাড়িটির অংশীদার হিসেবে ফজর আলীসহ ওই সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরাও রয়েছে। এক কথায় বলা চলে ফজর আলী নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের সদস্যরা দুর্নীতি ও অনিয়মের কাজ করে যাচ্ছে। ওই সিন্ডিকেটের মূলহোতা ফজর আলী, সাগর ও সবুজ সহ অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কাছে ও জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে সেবা গ্রহীতাদের একাধিক অভিযোগ থাকার সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর কারণে ওই সিন্ডিকেটের মূলহোতা সহ সদস্যরা একের পর এক ভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু খেসারত দিতে হচ্ছে সেবা গ্রহীতাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সাধারণ কর্মকর্তারা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমুল থেকে এখন পর্যন্ত ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই নিয়ন্ত্রণ করছে অফিসটি। তাদের কাছে অসংখ্য সেবা গ্রহীতা হয়রানি শিকার হয়েছেন এবং অনেক অর্থ তাদের কাছে দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন । তাদের কাছে সাব রেজিস্টারও জিম্মি হয়ে পড়েছেন। তারা পুতুলের মত কাজ করে যাচ্ছেন। এইসব দেখার কেউ নেই ! তাদের কাছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তাদের অর্থের কাছে সবাই মাথা নিচু করে আছে। ওই সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও অপকর্মের শেষ কোথায় কেউ কি জানেন? এই সিন্ডিকেট এতটাই প্রভাবশালী যে, লেস ভ্যালু (জমির দাম কমিয়ে) দলিল রেজিস্ট্রেশনসহ অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে তারা দক্ষ হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের ব্যবস্থা শুরু হলে সাময়িক সময়ের জন্য আত্মগোপনে থেকে আবারও শাহাবুদ্দিন পুনরায় তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু বর্তমানে ফজর আলী, সাগর ও সবুজের নেতৃত্বেই সিন্ডিকেটের সকল কাজ সফল করছেন তারা।
সাবেক নাইট গার্ড শাহাবুদ্দিনের নিকট আত্মীয় ফজর আলী, যার দৈনিক বেতন মাত্র ৬০ টাকা, সাব-রেজিস্ট্রারের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। অন্যদিকে, সবুজ পশ্চিমমুখী চেয়ারে বসে প্রতি দলিলের জন্য ন্যূনতম ৫ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা ঘুষ গ্রহণের কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রকাশ্যে সাগর দলিল এর ব্যাপার নিয়ে সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে সুকৌশলে অবৈধভাবে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে অন্য সদস্যরাও গ্রাহকদের হয়রানি করে সুকৌশলী জমি সংক্রান্ত দলিলপত্রের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখি মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। দিনশেষে সকল সিন্ডিকেটের সদস্যরা এক জায়গায় হয়ে যান। তারপরে ভাগাভাগি হয়ে যায়।
এক সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “এই অফিস পুরোপুরি দখলে নিয়ে রেখেছে সিন্ডিকেটের চক্র। শাহাবুদ্দিন, ফজর আলী, সাগর ও সবুজ তাদের অনুগত দলিল লেখক ও নকল নবীশদের মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ ও বণ্টন করে থাকে, যা ভাঙার ক্ষমতা যেন কারও নেই।” সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা, পিয়াস, নয়ন ও খোকনসহ আরো অনেকেই একইভাবে দুর্নীতি-অনিয়মের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই সঙ্গে কাজ করতো জসিম ও রাজীব। জসিম ও রাজীব বর্তমানে পল্লবী সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কাজ করছে। তাদেরও অপকর্মের শেষ নেই। তাদেরকে বলার কেউ নেই ! সিন্ডিকেটের সকল সদস্যরাই একই সুতার গাঁথা। তাদের বিরুদ্ধে কোনা প্রকার প্রতিবাদ করলে তাকে দিনের পর দিন বিভিন্ন ধরনের খেসারত দিতে হয়।
শাহাবুদ্দিনের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি
তথ্য অনুসারে, মিরপুর-১ নম্বর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাবেক নাইট গার্ড শাহাবুদ্দিন দুর্নীতি, ঘুষ ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছে। বর্তমানে অবসরে গেলেও সে অফিসে দালালি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তার অবৈধ সম্পদের তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো: বাসা: ১১৬/এ, শাহআলী বাগ, জনতা হাউজিং ৩ নম্বর গেট সংলগ্ন, মিরপুর-১, ঢাকা-১২১৬। ভবনটি সাড়ে ছয় তলা বিশিষ্ট, যেখানে ১৩টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ভবনটি আল কারিম কিরাতুল কোরআন মাদরাসাকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।
তায়েফ ভবন: বাসা-৩৭, পূর্ব শাহআলীবাগ, ধানক্ষেতের মোড়, মিরপুর-১, ঢাকা-১২১৬।
শাহাবুদ্দিনের মালিকানাধীন ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। জমি: সাভার থানার মশুরের গোলায় অবস্থিত ২০০ শতাংশ জমি, যার বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। বিলাসবহুল গাড়ি: ঢাকা-মেট্রো-চ-৫১-২১১৭ নম্বরযুক্ত একটি মাইক্রোবাস, যা তার নামে কেনা হয়েছে। এছাড়াও, তার নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও সিন্ডিকেটের ফজর আলী, সাগর, সবুজ, নয়ন, পিয়াস ও খোকনসহ তারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় এবং নিজ গ্রামের বাড়িতে নামে বেনামে অঢেল সম্পদ গড়েছেন । তাই একাধিক সেবা গ্রহীতাদের দাবি সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ওই সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য । তাদের কাছে সেবা গ্রহীতারা যেন আর হয়রানি ও প্রতারিত শিকার না হতে হয়।