স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, আগামীতে সুফল পাওয়া যাবে : নূরজাহান বেগম

বাসস: দেশের স্বাস্থ্যখাতে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। আগামী দিনগুলোতে এর সুফল পাওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।

আজ বৃহস্পতিবার বিকালে শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত এক বছরে স্বাস্থ্যখাতের অর্জন এবং ভবিষ্যৎ সংস্কার পরিকল্পনা বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এসময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী প্রমুখ।

এসময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে চৌদ্দ হাজারের অধিক সংখ্যক মানুষ আহত হন। ছাত্র আন্দোলনে এখন পর্যন্ত আহত ১৩,৮১১ জনের নাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। গেজেটে প্রকাশিত ভেরিফাইড আহতের সংখ্যা ১২,০৪২ জন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আহতদের তথ্য পাওয়া মাত্রই তা জেলা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে যাচাইপূর্বক এমআইএসের সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে মোট ৪০ জন জুলাই আহতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ করা হয়। যাদের মধ্যে থাইল্যান্ডে ২৬ জন, সিঙ্গাপুরে ১৩ জন এবং রাশিয়ায় ১ জন রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এ সকল রোগী মূলত চোখ, অঙ্গহানি, ব্রেইন এবং স্পাইনাল কর্ডে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত।

তিনি আরো বলেন, গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কর্তৃক মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার নিমিত্তে প্রেরণের লক্ষ্যে ১০৪ জন রোগীর তালিকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তন্মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৩৮ জন রোগীকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার লক্ষ্যে প্রেরণ করা হয়েছে।

বর্তমানে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সহযোগিতায় মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আরো আহত রোগীকে বিদেশের হাসপাতালে প্রেরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে উন্নত চিকিৎসার জন্য সর্বমোট ৭৮ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। দেশের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়ার পরও বিশ্বের ৭ দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি। সিঙ্গাপুর, নেপাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য ও থাইল্যান্ড হতে এ পর্যন্ত ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশে এসে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন এবং বেশ কয়েকজন আহতের সার্জারি সম্পন্ন করেছেন।

তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ আহত রোগীদের উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সহায়তা করবে। অভ্যুত্থানে আহত জুলাই যোদ্ধাদের আজীবন সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির জন্য স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গেজেটভুক্ত ১২,০৪২ জন জুলাই যোদ্ধার মাঝে ৭,৩৬৩ জনকে স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।

রোগীদের খাবারের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পথ্য খাতে জনপ্রতি বরাদ্দ ১৭৫ টাকা হতে ২৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া, আহতদের বিনামূল্যে হাসপাতালের বেড সেবা প্রদান করা হয়েছে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত জুলাই আহতদের উন্নত মানের চিকিৎসা দিতে সরকার চীনের সহায়তায় রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।

এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে। রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টারটিতে থাকছে ৬২টি উন্নত রোবোটিক থেরাপি ইউনিট, যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপির জগতে এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন ঘটবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা ছাড়াও অন্য রোগীদের জন্যও এ সেন্টার হতে সেবা গ্রহণের দ্বার উন্মোচিত হবে।

চিকিৎসা কাঠামো ও পদোন্নতি-নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, চিকিৎসকদের পেশাগত মর্যাদা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ৭ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমবারের মতো সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে চিকিৎসকদের ব্যাপক পরিসরে পদোন্নতির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসককে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, পরিচালক, জুনিয়র কনসালটেন্ট ইত্যাদি পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এর মাধ্যমে ৮৬টি বিষয়ে প্রায় ৮০০ চিকিৎসককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শূন্য পদে পদোন্নতির কার্যক্রম শেষে সুপার নিউমারারি পদে আরও প্রায় ৬,০০০ চিকিৎসককে বিভিন্ন পদে পদোন্নতি প্রদান করা হবে।

স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসকসহ জনবল সংকট সমাধানে আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছি। ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে ৩,০০০ জন চিকিৎসক নিয়োগের জন্য কার্যক্রম চলছে। পিএসসিতে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৪৫তম, ৪৬তম ও ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে আরও ৩,৫০০ জনের অধিক চিকিৎসক নিয়োগ কার্যক্রমও চলমান। এই সকল উদ্যোগের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যাবে এবং চিকিৎসক সংকট অনেকাংশে লাঘব হবে। শুধু চিকিৎসক নয় ইতোমধ্যে পিএসসি’র মাধ্যমে ৩,৫১২ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং এখন পদায়নের কার্যক্রম চলছে। এছাড়া, আরও ৯০০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন এবং ৫,০০০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স ও ৪,০০০ জন মিডওয়াইফের জন্য পদ সৃষ্টি সংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।

নতুন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন অধ্যাদেশ, ২০২৫” এর খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। এটি শিগগিরই অধ্যাদেশে পরিণত হবে। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নতুন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কাজও চলমান রয়েছে। বর্তমানে চীনের অনুদানে রংপুর বিভাগে ১,০০০ শয্যার হাসপাতাল, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রামে ৫০০ থেকে ৭০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এডিবি’র অর্থায়নে স্বাস্থ্যখাতে ডিজিটালাইজেশনের একটি প্রকল্প অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া, বিশ্বব্যাংকের সম্ভাব্য অর্থায়নে ওয়ান হেলথ্ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাণী থেকে মানবদেহে ছড়ানো রোগ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে।

চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে হার্টের রিং এর মূল্য কমানো হয়েছে। স্টেন্টের দাম সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ কমানো হয়েছে। স্টেন্টের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ৫% এর অতিরিক্ত অর্থ যেন গ্রহণ করা না হয় সে বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ক্যান্সার নিরোধক ওষুধ প্রস্তুতের জন্য আমদানিকৃত পণ্যের উপর আরোপণীয় উৎসে কর সংগ্রহের হার ৫% হতে হ্রাস করে ২% নির্ধারণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের প্রস্তাবনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হতে দেশে সকল ই-সিগারেট সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে ১ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। সরকারি বেসরকারি আটটি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এ দুর্ঘটনার শিকার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পাইলটসহ এ পর্যন্ত ৩৪ জন মারা গিয়েছেন। বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩৪ জন রোগী ভর্তি আছে। দেশীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াও সিঙ্গাপুর চীন ও ভারত থেকে বিশেষজ্ঞ এসে চিকিৎসা প্রদান করেছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও একটি চিকিৎসক দল পাঠাবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। হতাহত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মানসিক আঘাত প্রশমনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে চালু করা হয়েছে হটলাইন, বিশেষ ‘আউটডোর সাইকিয়াট্রিক সেল’ এবং অন্তর্বিভাগে সংরক্ষিত বেড। পাশাপাশি মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের সহায়তায় দ্রুত গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষ কমিটি। চালু হয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে আউটডোর সেবা এবং মাঠপর্যায়ে আউটরিচ কার্যক্রম। পাশাপাশি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি) এর সহায়তায় তিন শিফটে হটলাইন চালু রাখা হয়েছে, যাতে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যেকোনো ব্যক্তি সরাসরি পরামর্শ নিতে পারেন।

মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে সরাসরি যোগাযোগের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকায় ভর্তি হয়ে মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com