ভূমিকম্প নতুন বিপর্যয় নিয়ে এসেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ মিয়ানমারে

ইউএনবি নিউজ: গৃহযুদ্ধ, খাদ্য সংকট ও অর্থনৈতিক অবনতির মধ্যে মিয়ানমারে নতুন বিপর্যয় ডেকে এনেছে সাত দশমিক সাত মাত্রার ভয়াবহ এক ভূমিকম্প। এরপর থেকে ধ্বংসযজ্ঞের খবর আসতে থাকে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয় ও রাজধানী নেপিদো থেকেও।

এখন পর্যন্ত ১৪৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা গেছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডেও আটজন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার (২৮ মার্চ) দিনের মাঝামাঝিতে ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছে, যার গভীরতা ১০ কিলোমিটার বলে জানিয়েছে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস)।

বিবিসির খবরে বলা হয়, ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারে তথ্য পাওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। আক্রান্ত এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ ও ইন্টারনেট সেবার বাইরে চলে গেছেন লাখ লাখ মানুষ।

ভেঙে পড়েছে বহু এলাকার বাড়িঘর, মসজিদ, উপড়ে গেছে গাছ। ফাটল ধরেছে রাস্তায়, ভেঙে গেছে সেতু, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে। তবে মিয়ানমারে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র এখনও স্পষ্ট নয়। মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াজ বলেছেন, হাজার হাজার মানুষের জরুরি আশ্রয়, খাবার এবং চিকিৎসা সহায়তা দরকার।

বহু এলাকায় ভূমিকম্পের প্রভাব কতটা পড়েছে তা জানতে কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে বলেও তার ধারণা। রেড ক্রসের আশঙ্কা, মিয়ানমারের বড় বড় বাঁধগুলোতে কম্পনের কারণে ফাটল ধরে থাকতে পারে। ফলে বন্যাও দেখা দিতে পারে। এতে বিপর্যয় আরও বাড়বে।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) খবর বলছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর মান্দালয়ের কাছেই। পরে ছয় দশমিক চার মাত্রার একটি আফটারশক (পরাঘাত) হয়েছে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে মিয়ানমার জান্তা সরকারের প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেং বলেন, ‘এই ভূমিকম্পে অন্তত ১৪৪ জন নিহত ও ৭৩০ জন আহত হয়েছেন। হতাহতের শঙ্কা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়েপড়া রাজধানী নেপিদোর বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন ভবন মাটিতে মিশে গেছে। ধ্বংস্তস্তূপ থেকে আক্রান্তদের উদ্ধার করা হচ্ছে।

ভূমিকম্প ভয়াবহ আঘাত হানা এলাকাগুলোতে ‘জরুরিভিত্তিতে রক্তের’ চাহিদা বেড়েছে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। মান্দালয়ের সড়কগুলোতে বড় ধরনের ফাটল দেখা গেছে। একটি মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেতু ভেঙে পড়েছে। এতে কিছু এলাকায় উদ্ধারকারীদের পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে।

পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি মিয়ানমারে আগে থেকেই ব্যাপক মানবিক সংকট রয়েছে। ভূমিকম্পের আঘাতে তা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভূমিকম্পের তীব্রতার বিবরণ দিতে গিয়ে সিরিনিয়া নাকুতা নামের এক নারী বলেন, “কম্পন থামছিল না। উপরের তোলা থেকে পাথরের মত জিনিস খসে পড়ার শব্দ শুনতে পাই। তখন বাচ্চাদের বলি, আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না, বাইরে চলে যাওয়া উচিত।”

সন্তানদের নিয়ে নিজের নেপিদোর অ্যাপার্টমেন্টেই ছিলেন নাকুতা। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি শুরু হলে বেশ কিছু সময়েও তা না থামায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন তিনি।

মিয়ানমারের সবথেকে বড় শহর ইয়াঙ্গনের এক বাসিন্দা বলেন, কম্পন ছিল বেশ তীব্র। প্রায় চার মিনিট ধরে ঝাঁকুনি চলে।

আরেক ব্যক্তি ঘটনার বর্ণনায় বলেন, “ঘুম থেকে জেগে দেখি ভবন মারাত্মকভাবে দুলছে। কাঁপাকাঁপি প্রায় তিন থেকে চার মিনিট চলে। বন্ধুদের কাছ থেকে মেসেজ পাচ্ছিলাম। দেখলাম কম্পন শুধু ইয়াঙ্গুন নয়, দেশের অনেক এলাকাতেই হয়েছে।”

মান্দালয়ে ধ্বংসাবশেষের ছবি ও ভিডিও এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। রয়্যাল প্যালেস, ৯০ বছরের পুরনো ব্রিজ ধসে পড়ার পাশাপাশি আর মহাসড়কও ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।

এদিকে নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবন ভেঙে থাই রাজধানী ব্যাংককে আটজন নিহত হয়েছেন। মুহূর্তে বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এলাকাটি।

খবরে বলা হয়, রাজধানীর কাছাকাছি জনপ্রিয় চাতুচাক মার্কেটে ৩৩ তলার একটি নির্মাণাধীন ভবন ক্রেনসহ ধসে পড়েছে। সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়েপড়া ভিডিওতে দেখা যায়, এতে চারপাশে বিস্তৃত ধুলোর মেঘ ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের লোকজনকে আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি করে দৌড়াতে দেখা গেছে।

ব্যাংককের কেন্দ্রস্থলে সাইরেনের প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। যানজটে আটকাপড়ে ব্যস্ত সড়কগুলো। র‌্যাপিড ট্র্যানজিট সিস্টেম ও সাবওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ভূমিকম্প যে এলাকাটিতে আঘাত হেনেছে, সেটি ভূমিকম্পপ্রবণ। কিন্তু এসব ভূমিকম্প খুব বড় না। থাই রাজধানী থেকে যা টের পাওয়ার ঘটনাও বিরল। ব-দ্বীপের ওপর অবস্থিত ব্যাংককে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাঝারি।

প্রথমে ভূমিকম্পের বিষয়টি বুঝতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ব্যাংককের একটি ভবনে কাজ করা অপরিল কানিচাওয়ানকুল। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, আমার মাথা ঘোরাচ্ছে।’ সহকর্মীদের নিয়ে ভবনের দশতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যান তারা।

থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পুমথাম উইচাইয়াচি বলেন, ব্যাংককে ভবনধসে নিখোঁজ রয়েছেন ৯০ জন।

নিহতদের মধ্যে দুজন নির্মাণশ্রমিক। ভবন থেকে ইট-পাথরের টুকরা পড়ে তাদের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com