বন্ধুত্ব আর নারীর অগ্রগতির স্মারক ‘ওলো সই’

বাসস: কাকলি এবং ফাহমিদা দুই বন্ধু। তাদের বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের বন্ধুত্ব আজও অমলিন।

‘ওলো সই’ নামের যৌথ উদ্যোগ তাদের বন্ধুত্বকে করছে আরও সুসংহত আর সুনিবিড়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কাকলি শিক্ষকতা শুরু করেন। ইউডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাকলি তার চাকরি অব্যাহত রাখতে পারেননি। এভাবে কেটে যায় কয়েক বছর। কিন্তু কাকলির মধ্যে ছিল কিছু একটা করার অদম্য স্পৃহা। পরে স্বামী ও পরিবারের অন্যদের উৎসাহে শুরু করেন অন লাইন ব্যবসা।

‘সাভেরী’স ক্লদিং লাইন’ নামে সেই অনলাইনে ব্যবসা কয়েকবছরে বেশ ভালো একটা অবস্থানে পৌঁছে যায়। শাড়িই মূলত তাদের প্রধান পণ্য।

কাকলি বলেন, ‘আমার অনলাইনে শাড়ি ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল। প্রায় দশ হাজার ফলোয়ার রয়েছে আমার পেজে, ক্রেতাদের কাছ থেকে মোটামুটি ভালোই সাড়া পাচ্ছিলাম। কিন্ত আমি আমার ব্যবসাটাকে আরও বিস্তৃত করতে চাচ্ছিলাম।’

বন্ধু ফাহমিদা যে কিনা পেশায় একজন সাংবাদিক, সেও সাংবাদিকতার পাশাপাশি ব্যবসা করতে চাচ্ছিলো।

এই চিন্তা থেকেই শুরু হয় দুই বন্ধুর যৌথ উদ্যোগ ‘ওলো সই’। ঢাকার লালমাটিয়ায় রয়েছে তাদের সাজানো, গোছানো এবং শৈল্পিক শোরুম।

কি কি শাড়ি বিক্রি করা হয় তাদের শোরুমে, সেই প্রশ্নের জবাবে কাকলি বলেন, ‘আমরা মূলত তাঁত, মনিপুরী, জামদানি, খাদি, লিনেন এবং মটকা জাতীয় শাড়িই বিক্রি করে থাকি। দেশীয় শাড়ির বাজারকে সম্প্রসারিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।

আগের বছরগুলোতে সুতি, লিনেন ও মটকার চাহিদা বেশি ছিল বলে জানান তিনি।

বাংলার তাঁতের সুনিপুণ মোটিফ আর নকশাগুলোকে তারা ক্রেতাদের পোঁছে দিতে চান। দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরেও তারা পরিচিতদের মাধ্যমে শাড়ি বিক্রি করে থাকেন।

কাকলি বলেন, ‘এর মধ্যে কয়েকবার বিদেশে শাড়ি পাঠিয়েছি।’

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে দেশীয় শাড়ির বিপুল চাহিদা রয়েছে বলে তিনি জানান।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি নারীদের মাঝে বাংলার শাড়ির কদর আজও অটুট কারণ বাংলাদেশের হ্যান্ডলুম শাড়ি সুদক্ষ কারিগরদের হাতে তৈরি হয়, যা প্রতিটি শাড়িকে অনন্য করে তোলে। মূলতঃ জামদানি এবং মনিপুরী শাড়িগুলো ঐতিহ্যের অংশ এবং অসংখ্য ক্রেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এসব শাড়ি।

শোরুমের পাশাপাশি অনলাইনেও ‘ওলো সই’ তাদের শাড়ি ও অন্য পণ্য বিক্রি করে এবং তা সহজেই ক্রেতাদের কাছে  পৌঁছে দেয়।

শাড়ির প্রতি প্রচণ্ড রকমের ভালবাসা থেকেই শাড়ির ব্যাবসায় আসেন ফাহমিদা।

ফাহমিদা জানান, তারা মূলত দেশীয় শাড়িকে প্রাধান্য দিয়েই ব্যবসা করতে চান।

‘আমরা টাঙ্গাইল, রাজশাহী, সিলেট, সিরাজগঞ্জের স্থানীয় ভেন্ডরের মাধ্যমে শাড়ি  ক্রয় করি।’

ফাহমিদা বলেন, ‘আমরা চাই দেশীয় বাজারে ‘ওলো সই’ একটা ব্রান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হউক।’

মাস্টারকার্ডের ‘ইনডেক্স অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর (এমআইডব্লিউই)’ শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার ৩১.৬ শতাংশই নারী, যা ৫৪টি দেশের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। এই জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বল্প আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোতে নারীরা প্রয়োজনের তাগিদে উদ্যোক্তা হন এবং যেকোনো ব্যবসার সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগান।

সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং প্রায় ৬৮ লাখ কুটির শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার ৭.২১ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারী কেবল চাকরি নয়, বরং উদ্যোক্তা হয়েও অন্যের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

আর ফাহমিদা, কাকলির মতো নারীরা সেই পথটিই বেছে নিয়েছেন।

নিজেদের পাশাপাশি তারা অন্য নারীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।

কাকলি বলেন, সঠিক মার্কেটিং ও রপ্তানি পরিকল্পনা নেওয়া হলে বাংলাদেশি হ্যান্ডলুম শাড়ি বিশ্ববাজারে আরও জনপ্রিয় হতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

দুই বন্ধুর প্রয়াস ‘ওলো সই’ শুধু একটি ব্যবসা নয়, এটি নারীর ক্ষমতায়নের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *