ফারিয়ার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়-এটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড

ঢাকনাহীন ড্রেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মৃত্যুফাঁদ: প্রতিবাদে কেঁপে উঠল গাজীপুর!জিসিসির দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম ও জবাবদিহির অভাবই এই প্রাণহানির জন্য সরাসরি দায়ী।…..

মোঃ রফিকুল ইসলাম,গাজীপুরঃ গাজীপুর শহরে প্রতিদিন পথচলা যেন মৃত্যু সঙ্গে খেলা। আর সেই খেলার ভয়াবহ মূল্য দিলেন ফারিয়া তাসনিম জ্যোতি—একজন তরুণ কর্মজীবী মা, যিনি ঢাকনাহীন ড্রেনে পড়ে অকালে প্রাণ হারালেন। তার দুই অবুঝ শিশু এখন তাকিয়ে আছে অশিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। অথচ যারা দায়ী, তারা যেন আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছে। নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ আজ গর্জে উঠেছে সড়কে। সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে গেছেন সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—প্রশ্ন তুলেছেন সিটি কর্পোরেশনের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও নিষ্ঠুর নির্লিপ্ততার বিরুদ্ধে।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (জিসিসি) ন্যূনতম নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চরম ব্যর্থতা এবং অব্যবস্থাপনার চরম নজির হয়ে রইল কর্মজীবী নারী ফারিয়া তাসনিম জ্যোতির মর্মান্তিক মৃত্যু। ঢাকনাবিহীন ড্রেনে পড়ে মৃত্যুর পর তার দুই শিশুর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মুখে। এই ভয়াবহ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ, দোষীদের শাস্তি এবং ঢাকনাবিহীন ড্রেনের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল মানববন্ধন। মানববন্ধনের সময় পথচারীরাও থেমে দাঁড়ান।

বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৪, সকাল ১১টায় গাজীপুর শহরের শিববাড়ি এলাকায় গাজীপুর মিডিয়া সেন্টারের সামনে অনুষ্ঠিত এ মানববন্ধনে অংশ নেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা, নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক এবং সচেতন নাগরিকরা। আয়োজক ছিল নাগরিক সমাজ। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, “ফারিয়ার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়—এটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। জিসিসির দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম ও জবাবদিহির অভাবই এই প্রাণহানির জন্য সরাসরি দায়ী।”

সেখানেই, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে, তার পাশেই দেখা যায় আরেকটি দীর্ঘদিনের অবহেলায় পড়ে থাকা ঢাকনাহীন ড্রেন—যেটি যেন সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতার জীবন্ত প্রমাণ। মানববন্ধনে কয়েকটি প্রধান দাবি উঠে আসে:ফারিয়া তাসনিম জ্যোতির দুই শিশু সন্তানের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান। দায়ী প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা‌দের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ও প্রকাশ্য শাস্তির দাবি।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবিলম্বে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব খোলা ড্রেন ও ম্যানহোল ঢাকনার আওতায় আনতে হবে।

নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে স্বচ্ছ তদারকির ভিত্তিতে ড্রেন ও ম্যানহোল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

গাজীপুর নাগরিক কমিটির সভাপতি জুলীয়াস চৌধুরী বলেন, “গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ঢাকনাহীন ড্রেন আর ম্যানহোল যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অথচ কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বছরের পর বছর জনগণের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। ফারিয়ার মৃত্যু সেই ভয়াবহ অব্যবস্থাপনার নির্মম পরিণতি। ফারিয়ার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়—এটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। জনগণের করের টাকায় তৈরি ড্রেন যদি তাদের কবর হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে দোষটা কাদের? আর কত মৃত্যু হলে আপনাদের ঘুম ভাঙবে?”

তিনি বলেন, “এই মর্মান্তিক ঘটনার পূর্ণ তদন্ত, ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং সরকারের দায়িত্ব। অবিলম্বে এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে নাগরিক সমাজ আরও কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে “

তিনি আরও অভিযোগ করেন, “গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। বরং, আমাদের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, তারা দায়িত্ব এড়াতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক লবিস্ট নিয়োগ করছে। আমরা এই অপচেষ্টা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।”

গাজীপুর সাংবাদিক ঐক্য ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল বৈরাগী বিপ্লব বলেন, “আজ যদি আমরা প্রতিবাদ না করি, কাল হয়তো আমাদের সন্তানদেরও ঢাকনাহীন ড্রেন গিলে ফেলবে। ফারিয়ার মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—এই শহরে নাগরিক জীবন কতটা অনিরাপদ।”

ভাষা আন্দোলন পরিষদের সভাপতি আতিকুল ইসলাম, “জিসিসির ফাঁদে আর কাউকে মরতে দেব না”, “আমাদের সড়ক চাই, কবর নয়। আর কোনো ফারিয়া যেন আমাদের মা, বোন, বা কন্যা হয়ে এভাবে মৃত্যুবরণ না করে। নাগরিকদের জীবনের মূল্য যেন শুধুই ভোটের সময় মনে না পড়ে। ফারিয়ার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ডুবে যাক—এটা কি আমাদের সমাজ মেনে নেবে?”

সাংবাদিক ও কলামিস্ট মোঃ রফিকুল ইসলাম,দৈনিক ভোরের আলো পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল, আইনজীবী নূর নবী সরদার, শিল্পী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান রানা, গাজীপুর মিডিয়া সেন্টারের পরিচালক নাসির উদ্দিন ও নাশিদ আহমেদ তুষার, সাংবাদিক সাদেকুল ইসলাম, আব্দুল বারী, সাজ্জাদুল ইসলাম রাজ্জাক, মোহাম্মদ মোজাম্মেল সরকার, জোবায়ের হোসেন ইফতি, আফনান মামুন চৌধুরী, ফাতেমা আক্তার, সজীব হোসেন সুজন এবং ভাষা আন্দোলন পরিষদ ও মানবাধিকার সংগঠনের বহু সদস মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই আন্দোলন শুধু এক ফারিয়ার নয়, এটি পুরো শহরের নিরাপত্তাহীন নগর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক জোরালো সামাজিক চেতনাবোধের বহিঃপ্রকাশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com