টিসির প্রতিশোধে ছুরি: শিক্ষকের জীবনের ওপর ছাত্রীর আক্রমণ!

ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট, রাজশাহী : রাজশাহীতে একটি সাবেক স্কুল ছাত্রীর টিসি দেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে শিক্ষকের ওপর ছুরি হামলার পর বোয়ালিয়া থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের। বুধবার (২০ আগস্ট) রাতে মহানগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ অভিযুক্ত ১৬ বছরের কিশোরীকে হেফাজতে নেয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালতের নির্দেশে তাকে গাজীপুরের কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে, যা বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচন করে।

মামলার বাদী হলেন শিক্ষক মারুফ কারখী (৩৪), যিনি রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলা বিষয় পড়ান। ঠাকুরগাঁওয়ে বাড়ি থাকলেও তিনি বর্তমানে রাজশাহী মহানগরীর কাজলা এলাকায় বসবাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা মারুফ গত ১৯ আগস্ট ছাত্রীর হামলায় গলা ও হাতে গুরুতর আঘাত গ্রহণ করেন।

বৃহস্পতিবার রাতে (২১ আগস্ট) এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বোয়ালিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম আজাদ।

মারুফ কারখী জানান, “বুধবার থানায় গিয়ে মামলার এজাহারে সই করেছি। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মেয়েটি হেল্প-হেল্প বলে চিৎকার করছিল। ভেবেছিলাম কেউ বিপদে, তাই থেমে গিয়েছিলাম। পরক্ষণে সে দৌড়ে এসে ছুরি দিয়ে আঘাত হানল। বারবার আঘাত করার চেষ্টা করল, কিন্তু আমি ছুরিটা ধরে ফেললাম। মুখে মাস্ক থাকায় তাকে চিনতে পারিনি।”

ঘটনাটি ঘটে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের সামনের সড়কে। স্থানীয়দের সাহায্যে ছাত্রীকে আটক করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অভিযুক্ত ছাত্রী রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল, কিন্তু ২০২৩ সালে ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণ’ের দায়ে টিসি দেওয়া হয়। বর্তমানে সে শহীদ কর্নেল কাজী এমদাদুল হক পাবলিক স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ছে।

ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের এক কর্মকর্তা জানান, “টিসির কারণে তার মনে ক্ষোভ ছিল। এ ক্ষোভ স্কুলের সব শিক্ষক-কর্মকর্তার প্রতি ছিল। সুযোগ পেলেই সে কারও ওপর হামলা করতে চেয়েছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারুফ তার শিকার হন।” ঘটনার পর আহত শিক্ষককে সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হয়, যেখানে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন।

গত মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) বোয়ালিয়া থানার (সাবেক) অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। তারা জানিয়েছে, বিষয়টি নিজেরাই সমাধান করবে। থানায় কোনো অভিযোগ হয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।

টিসির প্রতিশোধের পেছনে গভীর কারণ: অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রীর এই হামলা স্কুল থেকে বিতাড়নের প্রতিশোধ হিসেবে পরিকল্পিত ছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি সাইবার বুলিংয়ে জড়িত ছিল এবং শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছিল। এই ঘটনা বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের বাড়তি হার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাহীনতার গুরুতর প্রমাণ।

কিশোর অপরাধের বিস্তৃত ছবি: বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল নয়। ২০২৪ সালে সিরাজগঞ্জে এক শিক্ষক ছাত্রকে গুলি করেন, কিন্তু পাল্টা হামলার ঘটনা বেড়েছে। ২০১৬ সালে হিন্দু শিক্ষককে ছুরি হামলা হয়, আর ২০২৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতার হত্যায় অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। UNICEF-এর ২০২৪ প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশে ৪৪.৪% ছাত্র বুলিংয়ের শিকার, এবং সাইবার বুলিংয়ের হার ৪৫% পৌঁছেছে। এই হামলা সাইবার প্রতিশোধের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

সমাজে প্রভাব: এই ঘটনা শিক্ষকদের মনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। মারুফ বলেন, “এ ধরনের হামলা আমাদের পেশায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।” স্থানীয় অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, “বাচ্চাদের স্কুলে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা বাড়ছে।” বোয়ালিয়া থানার সাবেক ওসি মোস্তাক আহমেদ জানান, “স্কুলে পুলিশ প্রবেশের অনুমতি ছিল না, তবে মামলা দায়েরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কিশোর সংশোধনের চ্যালেঞ্জ: কিশোর অপরাধ বাড়ার ফলে সংশোধন কেন্দ্রে ভিড় বেড়েছে, কিন্তু পুনর্বাসনের হার কমে গেছে। দারিদ্র্য, অভিভাবকের অভাব ও খারাপ সঙ্গ এর মূল কারণ। জরুরি পদক্ষেপের দাবি উঠেছে।

স্কুলে সাইবার সুরক্ষা প্রশিক্ষণ ও মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং চালু করা, কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ জোরদার করা, সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল সক্রিয়করণ, অ্যান্টি-বুলিং ক্যাম্পেইন, এবং পুলিশের সহায়তায় স্কুল নিরাপত্তা বাড়ানো প্রয়োজন। এগুলো কিশোরদের সংশোধন ও সমাজে পুনর্বাসনে সহায়তা করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com