কবি মনিরুল ইসলাম : বহুমাত্রিক অনুভূতির এক রূপকার -মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ

“জীবনের পাতায় পাতায় যত শব্দমালা গেঁথেছে এ প্রাণ
সুরে সুরে যদি তা যেত গাঁথা হত কত গান!

কখনো আনন্দ গৌরবে,
মাতাতো ধরনী সৌরভে
প্রাণ হত উচ্ছল চঞ্চল।
কখনো ব্যথার ভারে
করে দিত প্রাণ
নিথর নিরব নিশ্চল।

এই গৌরবের সরবতা আর ব্যথার নিরবতায়
গড়ে উঠা সমতার এ ধারা।
তাই বুঝি এত ভাল লাগে তারে,
মনে হয় ধরনী চির মনোহরা।”

আলোচ্য লাইনগুলো কবি মনিরুল ইসলামের “জীবন পাতায় শব্দের দ্বন্দ্ব” কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে। কবি মনিরুল ইসলামের কবিতার এ লাইনগুলো একজন মানুষের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি, জীবন-যন্ত্রণার প্রকাশ এবং সেই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পৃথিবীকে ভালোবাসার এক গভীর উপলব্ধিকে তুলে ধরে। নিচে আমরা কবিতাটির মূল ভাবনা, সাহিত্যিক গঠন ও সাহিত্যিক উদাহরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করছি:

১. মূল ভাব ও বার্তা:

কবি বলতে চেয়েছেন:
মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি অনুভূতি—সুখ, দুঃখ, আনন্দ, গৌরব, যন্ত্রণা—এসব একত্রে মিলেই জীবনকে পূর্ণ করে তোলে। এই অনুভবগুলো যদি শব্দে ও সুরে প্রকাশ হতো, তবে তা অসংখ্য গানে রূপ নিত।

শেষে কবি বলেন, এই বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার (সুখ-দুঃখের, গৌরব-নিঃসঙ্গতার) মধ্যেই জীবনের সত্য ও সৌন্দর্য নিহিত। এজন্যই পৃথিবী, বা ‘ধরনী’, এত ভালো লাগে।

২. সাহিত্যিক গঠন ও অলঙ্কার:

(ক) রূপক (Metaphor):

> “জীবনের পাতায় পাতায় যত শব্দমালা”
— জীবনকে এখানে “বইয়ের পাতা”-রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এটি একটি রূপক, যেখানে জীবন = পুস্তক।

(খ) গীতিমূলকতা (Lyrical quality):

> “সুরে সুরে যদি তা যেত গাঁথা, হত কত গান”
— এটি একটি অত্যন্ত গীতিময় (lyrical) পঙ্‌ক্তি, যা জীবনের অভিজ্ঞতাকে গানের সুরে বাঁধার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।

> উদাহরণ:
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের:
“জীবন যদি তবু জীবন হত, সুরের মতন” — একই রকম ভাবনা।

(গ) বিরোধাভাস (Contrasts):

> “কখনো আনন্দ গৌরবে… / কখনো ব্যথার ভারে…”
— কবি এখানে জীবনকে সুখ-দুঃখ, গৌরব-ব্যথা, সরবতা-নীরবতার দ্বন্দ্বে সাজিয়েছেন। এই বৈপরীত্য (contrast)-র মাধ্যমেই জীবনের গভীরতা বোঝানো হয়েছে।

> উদাহরণ:
– জীবনানন্দ দাশ:
“জীবন, মৃত্যুর সীমারেখায় / চলেছি একা…”

(ঘ) প্রতীক ও বিমূর্ততা (Symbolism):

> “প্রাণ হত উচ্ছল চঞ্চল / নিথর নিরব নিশ্চল”
— এই শব্দগুলো জীবনের মানসিক অবস্থার প্রতীক। “উচ্ছল চঞ্চল” = আনন্দময়; “নিথর নিরব” = দুঃখ ভারাক্রান্ত।

৩. কবিতার সারসংক্ষেপ:

এই কবিতায় কবি জীবনের অভিজ্ঞতাকে সংগীত ও শব্দের রূপকে দেখেছেন। জীবন কখনো গৌরবে দীপ্ত, কখনো দুঃখে নিস্তব্ধ, কিন্তু এই দুয়ের মিলিত রূপেই জীবন পূর্ণ হয়। এজন্যই এই পৃথিবী, এই জীবন এত মনোহর মনে হয়।

৪. সাহিত্যিক তুলনা (উদাহরণ):

> (i) কাজী নজরুল ইসলাম – “আমার কৈফিয়ত”:
“সুরে সুরে কাঁদি আমি…” — এখানে যেমন দুঃখকে সুরে রূপ দেওয়া হয়েছে।

> (ii) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “জীবন স্মৃতি”:
“জীবনের গান গাই” — তিনি জীবনের রসকে গানে রূপ দিয়েছিলেন।

৫. চূড়ান্ত উপলব্ধি:

> “তাই বুঝি এত ভাল লাগে তারে, মনে হয় ধরনী চির মনোহরা।”
— সব অনুভূতির সমাহারে কবির দৃষ্টিতে পৃথিবী হয়ে উঠেছে চিরপ্রিয়, চিরসুন্দর।

আসলে জীবন কখনো গান, কখনো নীরবতা; কখনো উচ্ছ্বাস, আবার কখনো নিস্তব্ধ এক ব্যথার প্রতিধ্বনি। কবি মনিরুল ইসলামের কবিতায় আমরা পাই এমন এক জীবনচিত্র, যেখানে প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি অভিজ্ঞতা শব্দ হয়ে উঠে আসে, আর সে শব্দমালায় গাঁথা হয় জীবনের অন্তরঙ্গ সংগীত। কবি বলেন:

“জীবনের পাতায় পাতায় যত শব্দমালা
গেঁথেছে এ প্রাণ—
সুরে সুরে যদি তা যেত গাঁথা,
হত কত গান!”

এই কবিতায় জীবনের বহুমাত্রিক অনুভূতির এক সংবেদনশীল রূপকল্পনা ফুটে উঠেছে। কবি জীবনের অভিজ্ঞতাকে তুলনা করেছেন এক পাণ্ডুলিপির পাতার সঙ্গে, যেখানে সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিচ্ছেদ, আশাভঙ্গ কিংবা নতুন আশার বীজ—সব কিছুই জমা থাকে শব্দ হয়ে। সেই শব্দ যদি সুরে বাঁধা যেত, তবে তা কত মধুর, কত প্রাণস্পর্শী গানে রূপ নিত!

এই ভাবনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তন বাণী—
“আমার জীবনপথে যতই যাই গো / সুরে সুরে সেই কথা কহ গো…”
— যেখানে জীবন নিজেই হয়ে ওঠে এক চলমান সংগীত।

কিন্তু মনিরুল ইসলামের কবিতার পরিধি কেবল আনন্দে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি সেই সব নিঃশব্দ অনুভবের কথাও বলেছেন, যা আমাদের কণ্ঠে কোনো সুর আনে না, শুধু নীরবতা রেখে যায়। কবি লিখেছেন:

“কখনো ব্যথার ভারে করে দিত প্রাণ
নিথর, নিরব, নিশ্চল।”

এই পঙ্‌ক্তিগুলিতে কবি যেন জীবনের সেই দিকটিকে তুলে ধরেছেন, যা আমরা অনেক সময় চেপে রাখতে চাই—যন্ত্রণার ভার, নিঃসঙ্গতার শূন্যতা, হাহাকারের স্তব্ধতা। তবু এই ব্যথার মধ্যেই যে এক গভীর সৌন্দর্য আছে, সে সত্যও কবি অস্বীকার করেননি।

এই দ্বৈত অভিজ্ঞতার মাঝেই জীবনের যে সমতা—তা-ই কবির কাছে হয়ে উঠেছে চরম উপলব্ধির উৎস। জীবনের এই গৌরব ও নীরবতা, উল্লাস ও বিষণ্ণতা—সব মিলিয়েই যেন গড়ে উঠে এক ভারসাম্যপূর্ণ সৌন্দর্য। তাই কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয় পরম ভালোবাসার বাণী:

“তাই বুঝি এত ভাল লাগে তারে,
মনে হয় ধরনী চির মনোহরা।”

এ যেন জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে উচ্চারিত—
“বিশ্বযাত্রার সাথে আমি গান গাই…”
— সেই চিরন্তন মিলনের স্পর্শ।

এই কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবন কখনোই একরৈখিক নয়। তার সৌন্দর্য তার বৈচিত্র্যে, তার সুর তার বিপরীতের মাঝে। সেই কারণেই হয়তো যন্ত্রণার মাঝেও জন্ম নেয় শ্রেষ্ঠ শিল্প, নীরবতার মধ্যেও ধ্বনিত হয় গানের প্রতিধ্বনি।

মনিরুল ইসলামের কবিতাটি তাই কেবল একটি কাব্যিক নির্মাণ নয়, এটি এক গভীর জীবনচেতনার প্রকাশ। যিনি হৃদয় দিয়ে জীবনকে অনুভব করেন, তিনি জানেন—এই পৃথিবী, এই জীবন—সবকিছুই ভালোবাসার যোগ্য, কারণ সবকিছুই আমাদের নিজস্ব অনুভবের প্রতিচ্ছবি।

লেখক পরিচিতি :
মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ,
চেয়ারম্যান, ভিন্নমাত্রা রিসার্চ সেন্টার,
সম্পাদক -মাসিক ভিন্নমাত্রা
মোবাইল : ০১৭১২০০৫৯৫৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com