স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন: এখনও অক্ষুণ্ন কিছু সমস্যার মুখোমুখি

বিশেষ প্রতিনিধি: ১৯৭১ সালের পর, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা একটি বড় বিজয় অর্জন করেছিল। কিন্তু এই বিজয়ের সঙ্গে পরাজয়ের স্বাদও মেনে নিতে হয়েছিল। বিজয়ের কারণ ছিল দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চলা স্বৈরশাসন, দুর্নীতি, শোষণ, দমন-নির্যাতন ও সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। পরাজয় এসেছে কারণ, এত সব সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পরও ক্ষমতা জনগণের হাতে আসেনি। বরং, ক্ষমতা রয়ে গেছে সেই পুরনো শক্তিগুলোর হাতে, যারা এরশাদ সরকারের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল।

এখনকার স্বৈরাচারী শাসনের চিহ্নগুলোর ভূমিকা ও অবস্থান আরও পরিষ্কার হয়েছে। এই শক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, সামরিক জেনারেল, বেসামরিক আমলাতন্ত্র, লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী, বড় ব্যবসায়ী, চোরাচালানকারী এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে এরশাদ সরকারের পতনের পর লিখেছিলেন, স্বৈরাচারী শাসকদের কেবল পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এর পেছনে যে খুঁটিগুলো রয়েছে, সেগুলোর সমাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও সেসব সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি, ফলে স্বৈরাচারী খুঁটিগুলো এখনও অক্ষুণ্ন রয়ে গেছে।

বর্তমানে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার পতন উদযাপনের প্রেক্ষিতে, এই পুরনো বার্তাগুলো স্মরণ করা জরুরি। ’৯০-এর আন্দোলনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন না হওয়ায় স্বৈরাচারী প্রক্রিয়া বহাল ছিল। তাই, নতুন সরকারের জন্যও এই শিক্ষাগুলো মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান ও আইনি সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে গত দেড় দশকের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া। এ জন্য জাতিসংঘের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, রাজনৈতিক হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নথিগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করা জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দুদক, গোয়েন্দা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে থাকা তথ্যপ্রমাণ প্রকাশ করা প্রয়োজন। এসব তথ্য প্রকাশ না হলে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে পারে।

ভারতের সিদ্ধান্তও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কারণ ভারত এখনও শেখ হাসিনার সমর্থক হিসেবে পরিচিত। চলতি পরিস্থিতিতে, বিদেশি চুক্তিগুলোর পর্যালোচনা করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করার প্রয়োজন। এর ফলে জানা যাবে, কিভাবে এসব চুক্তি দেশের স্বার্থকে প্রভাবিত করেছে।

স্বৈরাচারী শাসনের অবশেষগুলো এখনও আমাদের সামনে বিদ্যমান। নতুন সরকার এবং অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতাকে সতর্ক থাকতে হবে যেন পুরনো সমস্যাগুলো পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *