পার্থ প্রতিম ভদ্র : ফরিদপুরে পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন ৫৬ জন তরুণ-তরুণী। এর মধ্যে তরুণ ৫০ জন ও তরুণী ছয়জন। বুধবার (২০ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফরিদপুর পুলিশ লাইনস-এ নির্বাচিত ওই তরুণ-তরুণীদের নাম ঘোষণা করা হয়।
এ সময় ওই জায়গায় এক আবেগঘন আনন্দ উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আনন্দে অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। যে ৫৬ জন তরুণ-তরুণী প্রাথমিক ভাবে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তারা বেশির ভাগই অত্যন্ত গরীব পরিবের সন্তান। হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য অনেকেই। পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। এদেরই একজন অসীম কুমার দাস (১৯)। তিনি ফরিদপুর সদরের গেরদা ইউনিয়নের বাখুন্ডা গ্রামের জেলে অনিল কুমার দাসের ছেলে।
অনিল কুমার দাস বলেন, দুই ছেলে নিয়ে চারজনের সংসারে সবার মুখে ভাত তুলে দেওয়া কষ্টকর। দিনে কামাই দিনে শেষ এই ভাবে সংসারের চাকা চলে। বড় ছেলে অসীম কুমার দাস পুলিশের চাকুরি পাওয়ায় ও দুই টাকা কামাই করবে, আমি দুই টাকা কামাই করবো এই ভাবে সংসারের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হবে আশা করি।
অসীম কুমার দাস জানায়, তিনি ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে একাউন্টিং অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। গতবছর তিনি পুলিশের চাকুরির চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ভাইভা বোর্ড থেকে তাকে বিদায় করে দেয়। এক দালাল টাকা চেয়েছিল তিনি টাকা দিতে রাজি হননি। তবে এবার ১২০ টাকায় তিনি চাকুরি পেয়েছেন। একটা টাকাও বেশি দিতে হয়নি। যা বাড়তি খরচ হয়েছে তা বাড়ি থেকে আসা-যাওয়ার জন্য যা খরচ হয়েছে।
পুলিশের চাকুরি পেয়েছেন ফরিদপুর সদরের কৈজুরি ইউনিয়নের বিলনালিয়া গ্রামের সোনালী আক্তার (২০)। সোনালী আক্তারের বাবা একজন কৃষক। পাঁচ বোন ও এক ভায়ের মধ্য তিনি সবার বড়।
সোনালী জানায়, সব মিলিয়ে পরিবারের সদস্য আটজন। কৃষক বাবা সাদেকউদ্দিনের পক্ষে পরিবার চালানো কষ্টকর। বাড় কোন ভাই থাকলে হয়তো বাবার কোজে সাহায্য করতে পারতো। আমি চাকুরি পেয়ে সংসারের কাজে লাগতে চাই। আমার কোন বড় ভাই নেই। আমি এখন বড় ভায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারবো।
১২০ টাকায় পুলিশের চাকুরি পেয়েছেন ফরিদপুর সদরের মাচ্চর ইউনিয়নের শিবরামপুর চন্ডিপুর গ্রামের মো. মোহসিন মল্লিক। মোহসিন ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে একাউন্টিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা আক্কাস মীর একজন অটোচালক। তার আয়ে সংসার চলে না চলার মত।
মোহসিন মল্লিক জানায়, আমরা দুই ভাই এর মধ্যে আমিই বড়। বাবার আয়ে সংসার চলে না। এজন্য চাকুরির করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানায় মোহসিন।
আবেগে আপ্লুত মোহসিন বলেন, চাকুরি পাওয়ার অনুভুতি ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না। পুলিশের এ চাকুরি পেয়ে মনে হয়েছে অকূল পাথারের মধ্যে একটা অবলম্বন পেলাম বেঁচে থাকার জন্য পরিবারের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য।
জেলা পুলিশ সুত্রে জানা গেছে গত ২৯-৩০-৩১ অক্টোবর পুলিশ কনস্টেবল শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় আড়াই হজার তরুণ তরুনী অংশ নেয়। ৫৫৪ জনকে নির্বাচিত করা হয় লিখিত পরীক্ষার জন্য। এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১২ নভেম্বর। এর মধ্যে থেকে ১৯৭জনকে নিয়ে ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত ১৯-২০ নভেম্বর। ২০ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রাথামিক নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করা হয়।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার(এসপি) মো. আব্দুল জলিল জানান, চলতি বছর পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ফরিদপুর জেলার প্রাথমিকভাবে যারা নির্বাচিত হয়েছে তারা সম্পূর্ণ তদবিরবিহীন, প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছে।
নির্বাচিতদের নাম ঘোষণার সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে পুলিশ সুপার জনাব আব্দুল জলিল বলেন, নাম যখন ঘোষাণা শেষ তখন এক প্রার্থী কান্নাকাটি করে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। আমরা ৫৬ জনের না ঘোষণা শেষ কেরে দেখতে পাই নির্বাচিতদের মধ্যে ৫৫জন সেখানে উপস্থিত। একজন মেঝেতে শুয়ে আছেন। পরে তাকে সুস্থ করে তোলা হলে তিনি বলেন, আমি অনেক ভাল পরীক্ষা দিয়েছি অখচ আমি নির্বাচিত হইনি। আমি বাড়ি গিয়ে মুখ দেখাবো কি করে। পরে আমরা তালিকা চেক করে দেখি নির্বাচিতদের মধ্যে তিনিও আছেন তবে নাম ঘোষণার সময় তিনি ভুলবশত তার নামটি শুনতে পারেননি। এখবর শোনার পর ওই তরুণের হাসিমাখা আনন্দাশ্রু আমাদের সকলের হৃদয় ছুয়ে যায়।